ভারত-বাংলাদেশ তিস্তাচুক্তি বিষয়ক আলোচনার প্রেক্ষাপট ও গতিবিধি
হিমালয়ের ৭,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদীটি। নীলফামারি জেলার খড়িবাড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে এদেশে প্রবেশ করে আরো চারটি জেলার (লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা) উপর দিয়ে তিস্তা নামেই প্রবাহিত হওয়ার পর চিলমারী নদী বন্দরেরর দক্ষিণে এসে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়। যদিও অষ্টাদশ শতকের আগে নদীটি বিভিন্ন নদীপ্রবাহের মাধ্যমে গঙ্গা নদীতে এসে মিলিত হতো। তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিমি। এর মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশে আর ২০০ কিলোমিটার ভারতে অবস্থিত। এই নদীটি ভারতের সিকিম রাজ্যের প্রধান নদী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগেরও প্রধান নদী হিসেবে বিবেচিত হয় এই তিস্তা। আবার বাংলাদেশেরও অন্যতম প্রধান নদীগুলোর একটি তিস্তা নদী। এ নদীর মাসিক গড় পানি অপসারণের পরিমাণ ২,৪৩০ কিউসেক। দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই নদীটির পানি কোন দেশ কতটা পাবে তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো বোঝাপড়া হয়নি। এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি এখনো স্বাক্ষরের অপেক্ষায়।
নদীভিত্তিক সেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প বাংলাদেশে সফলতার মুখ দেখেছিল। ২০০১ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান অধিদপ্তর দেখিয়েছিল, তিস্তা অববাহিকায় রয়েছে দেশের মোট আবাদি জমির শতকরা ১৪ ভাগ। এই অববাহিকার শতকরা ৬৩ ভাগ আবাদি জমি সেচের আওতাধীন। সেচের পানির প্রাপ্যতার ফলে এ অঞ্চলে বছরে দুটি ফসল ঘরে তোলার একটি সুযোগ তৈরি হয়, যা এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।
কিন্তু তিস্তায় পানির প্রবাহ ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়ায় এই প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে উত্তরবঙ্গের মানুষ। অথচ শুরুতে পরিকল্পনা ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে দুই ধাপে। প্রধম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে, যার আওতায় মূলত রংপুর ও নীলফামারী জেলায় সেচের সুবিধা পৌছেছে। দ্বিতীয় ধাপে দিনাজপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কিন্তু ভারতের গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মানের করে এই নদীর পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে গেছে। সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। শুধু তাই নয়, তিস্তা অববাহিকায় কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে জীবনযাত্রা ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। যার ফলে এই মূহুর্তে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আন্তঃসীমান্ত নদীসমুহের উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশন (জ়েআরসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকেই আলোচনা শুরু হয়, তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে। ১৯৮৩ সালে তিস্তা নদীর ভারতীয় অংশে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ও বাংলাদেশ অংশে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে প্রায় একই সময় গ্রীষ্মকালীন সেচের জন্য ব্যারেজ নির্মান কাজ শুরু হয়। এতে তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে আলোচনা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ১৯৮৩ সালে যৌথ নদী কমিশনের ২৫ তম বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারত তিস্তার পানি বন্টনের জন্য একটি এডহক চুক্তি করার বিষয়ে সম্মত হয়েছিল। সেসময় তিস্তার মোট প্রবাহের ২৫% কে বন্টনের আওতার বাইরে রেখে বাকি ৭৫% শতাংশ দু’দেশের মধ্যে ভাগ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা নির্ধারিত হয়েছিল ৩৬% আর ভারতের ৩৯%। তবে এই পানিবন্টন কোথায় এবং কি পদ্ধতিতে হবে সেটি নিয়ে দ্বিমতের জের ধরে সেই এডহক চুক্তিটি বাস্তবের মুখ দেখেনি।
১৯৮৭ সালে ভারতের গজলডোবায় ব্যারেজ নির্মান কাজ শেষ হয়। মোট ৯.২৩ লক্ষ হেক্টর এলাকায় সেচ প্রদানের প্রকল্প হাতে নেয় ভারত আর ৫.৪৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের জন্য তিস্তার পানি প্রত্যাহার শুরু করে। এদিকে, বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারেজের নির্মান কাজ শেষ করে, ১.১১ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচের প্রকল্প শুরু হয়। শুরুতে এই ব্যারাজ নির্মানের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের একটি ধারা সূচিত হয় সত্যি। কিন্তু ভারত ক্রমাগত তিস্তার পানি প্রত্যাহার বাড়াতে থাকায় শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহ কমতে থাকে।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় আর তারপর থেকেই তিস্তার পানিবন্টনে চুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সচিবপর্যায়ের এক বৈঠকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কাজ ছিল যৌথ নদী কমিশনের নির্দেশক্রমে তিস্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অন্যান্য অভিন্ন নদীর বিষয়ে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি পানি বণ্টন ফর্মুলা প্রণয়ন করা। বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কয়েক দফা বৈঠক করে, কিন্তু এসব বৈঠকে এ বিষয়ে কোন ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ ও ভারত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১০ই জানুয়ারি দিল্লি সফরে যান। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীরসমূহের পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাস, সীমান্তে বিএসএফের হত্যা, তিনবিঘা করিডোর, সমুদ্রসীমার মীমাংসা, তালপট্টি সমস্যাসহ নানা ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির আশা ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। কিন্তু সফরটি শেষ হয় তিনটি চুক্তি এবং দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর আর দুই প্রধানমন্ত্রীর যুক্ত ইশতেহার প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে।
শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত না হওয়ায় শেষ নাগাদ আশা করা হয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে ইস্যুটির একটি সুরাহা হবে। শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কিন্তু একই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি না করতে চাপ প্রয়োগে আন্দোলনে নামেন খোদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ফলে বহুল আলোচিত তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টনে ১৫ বছর মেয়াদি দুটি চুক্তিস্বাক্ষরে রাজি হয়নি ভারত। এ কারণেই বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেনি ট্রানজিটের সম্মতিপত্রে। ওই সফর শেষ হয় দু’দেশের মধ্যে মোট ৯টি প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার মধ্য দিয়েই। কিন্তু মনমোহন সিংয়ের সফরের পর বলা হলো খুব শিগগিরই এ চুক্তি স্বাক্ষর হবে।
এরপর থেকে ভারতীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর বাংলাদেশ সফর ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনির ভারত সফরে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের দেশে তিস্তা চুক্তি বিষয়ে জাতীয় ঐক্য হলেই তারা তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করবে। (তথ্যসূত্র: অনলাইন)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমার কথা ভালো লাগবে এমন নাও হতে পারে
ভালো না লাগলে কী ও কেন ভালো লাগেনি
উল্লেখ করে কমেন্ট করুন
আর ভালো লাগলে তো জানাতেই পারেন