ক্যাসিনো কান্ডের পরেও জুয়া বন্ধে ইংরেজদের চাপিয়ে দেওয়া আইনটি সংস্কারের দিকে বোধ হয় আমাদের দৃষ্টি নেই
যে আইনবলে এখনও এদেশে আদালত জুয়াড়িদের সাজা দেন- সেই প্রকাশ্য জুয়া আইন বা Public Gambling Act ১৮৬৭ সালে প্রণীত।
তার মানে আইনটি ব্রিটিশ সরকারের আমলে প্রণীত। ব্রিটিশ সরকার সেসময় এই দেশের জন্য আইনটি প্রণয়ন করে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তাদের কৃষ্টিকে আমরা যেমন ধরেই রেখেছি, তেমনি একেবারে প্রায় অবিকল অবিকৃত রেখে সেসময়ে প্রণীত আইন আজো বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আমাদের দেশে পুলিশ অভিযান চালিয়ে জুয়াড়িদের ধরছে, মোবাইল কোর্ট সাজা দিচ্ছে সেই আইনবলে। কিন্ত নিজ দেশে যে ব্রিটিশরা বৈধ পথে জুয়া খেলার ব্যবস্থা করতে ক্যাসিনো তৈরি করেছে, সেখানে জুয়া পরিচালনা করে জুয়া থেকে আয় করছে রাজস্ব- সেদিকে কোনদিন নজর দেননি আমাদের দেশের আইনপ্রণেতারা।
জুয়ার স্পটগুলো চিনে রেখে যে কোন সময় নিজের পারফমেন্স দেখানোর প্রয়োজন হলে বা বাড়তি টাকা দরকার হলেই পুলিশ হানা দেয় সেসব স্পটে।
আমাদের দেশে বিশেষভাবে অনুমোদিত হাউজি খেলাগুলো দেখলেই বুঝতে সমস্যা হয় না এটি কতটা জনপ্রিয়, যদিও এ জনপ্রিয়্তা হয়তো নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ থেকে উৎসারিত। শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত জুয়ার আড্ডা চালিয়ে কতজন টাকার পাহাড় গড়েছে- তার ইয়ত্তা নেই এদেশে। পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে আবার তারাই নিঃস্ব হয়ে গেছে- সে চিত্রটাও এদেশের পরিচিত।
এত অভিযান-জেল-জরিমানার পরও জুয়াড়িদের নতুন কোন আড্ডায় জুয়া খেলতে যাওয়ার নেশা দেখে বুঝতে মোটেই সমস্যা হয় না যে, মানুষের এই প্রবৃত্তিকে হয়তো পুরোপুরি নিবৃত্ত করা সম্ভব নয়। তাই জুয়াকে নিরুৎসাহিত করতে একটি টেকসই ব্যবস্থা প্রয়োজন এদেশে। কেননা জুয়া খেলতে গিয়ে ধরা খেয়ে জেল খেটে এলে জুয়ার প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হয় মানুষ।
জুয়াকে নিরুৎসাহিত করতে অত্যাধিক মাত্রায় করারোপ করে, তারপরও যারা আগ্রহী তাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সুযোগ রাখতে ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যুক্তরাজ্যসহ বেশিরভাগ দেশে। জুয়াকে নিরুৎসাহিত করা আর রাজস্ব আয় একসূত্রে গাঁথা ওইসব দেশগুলোতে।
আর আমাদের দেশে ভয়ানক ঘটনা ঘটছে জুয়া নিয়ে। জুয়া নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির পেছনে ব্যায় করার অর্থ নেই। নিষিদ্ধ বলে পুলিশ সরকারি বেতনে ডিউটিতে জুয়াচোর ধরছে, মানে তার বেতন জুয়ার জন্য গেল। যাদের ধরছে তাদের টাকা নিচ্ছে। বেতন আর এই ঘুষেও পুলিশের চলছে না। শেষে, যাদের ধরলো, তাদের কয়েকজনকে বড় অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে আবার ছেড়ে দিচ্ছে। মানে, সরকারি বেতন নিয়ে এতগুলো অবৈধ আয়ের ব্যবস্থা করছে।
তারপর, যাদের ধরলো তাদের রাষ্ট্রীয় খরচে জেলে পুষতে হচ্ছে সরকারকে। এতে করে সহজ আয়ের ব্যবস্থা থাকায় মামলার তদন্তকাজে পুলিশের আগ্রহ বা সময় কোনোটাই থাকছে না। অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেশে মামলাজট বাড়ছে দিনকে দিন। কিন্তু বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় আমাদের আইনপ্রণেতারা এবিষয়ে কথা বলছেন না। জনগণের ভোট চাইতে হয় বিধায় স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলে বিতর্কিত হওয়ার ঝুঁকি নিতে নারাজ তারা। ফলে নিষিদ্ধ শব্দটিকে পুঁজি করে পুলিশের অবৈধ আয় ক্রমেই বাড়ছে আর সরকারের জুয়া বন্ধে খরচও বাড়ছে, যা বহন করতে হচ্ছে জনগণকেই।
অথচ ক্যাসিনোতে জুয়া চললে, একদিকে প্রকাশ্য হতো না, অন্যদিকে এই আয় দিয়ে জুয়ার ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে জনসচেতনতার কর্মসূচি নেয়ার সুযোগ তৈরি হতো। পুলিশের অবৈধ আয়ের সুযোগ কমতো। পুলিশকে হয়তো সামান্য হলেও বেশি মনোযোগ দিতে হতো অপরাধের তদন্তকাজে।
অনেক জুয়াড়িকে বলতে শুনেছি, অন্য দেশের মতো বৈধভাবে খেলার সুযোগ নেই বলে গোপনে খেলছি জুয়া। ইউএস, ইউকে এর মতো উন্নত দেশই শুধু নয়, ভারত-শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও আছে ক্যাসিনো। ছোটবড় কারো দৃষ্টান্তও অনুসরণ না করে, মৌলবাদের মতো ইংরেজদের চাপিয়ে দিয়ে যাওয়া আইনটিকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে নিয়ে চলছে দেশ। এই সিস্টেম চললে প্রকাশ্য জুয়া কোনদিন বন্ধ হওয়ার নয় বলে আমার বিশ্বাস। ক্যাসিনোতে জুয়া চললে তা প্রকাশ্য হতো না এবং নিয়ন্ত্রণে আরো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হতো।
কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?
এত যার ব্যাপকতা, এত যাতে মোহ, এত যার প্রভাব তার প্রতিকারে সারা বিশ্ব কী ব্যবস্থা নিচ্ছে- সেদিকে নজর দেয়ার সময় এসে গেছে।
অবৈধভাবে চালিয়েই যদি এত টাকা তাহলে তা বৈধ হলে কত বড় রাজস্বের যোগান দিতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। মাঝখানে পুলিশসহ কিছু শ্রেণীর নিয়মিত মোটা অঙ্কের অবৈধ আয়ের পথ বন্ধ করে দিতে পারে বলে ফাইনালি বৈধতার প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়নি এদেশে।
বিশ্বকে জানতে গিয়ে আজ আর এ জানতে বাকি থাকছে না কত দেশে কত ক্যাসিনো। পশ্চিমারা বৈধ করে দিয়ে দেখতে পাচ্ছে এসবের চাইতেও বেশি প্রভাবশালী ক্রিকেট, ফুটবলের মতো জনপ্রিয় খেলা নিয়ে যখন যেখানে সেখানে জুয়া হয়ে যায়। তার চেয়েও ক্ষতিকর হয় তখনই যখন বাজিকরের কারণে মাঠের খেলায় পরিবর্তন হয়ে যায়।
শুধু ক্যাসিনো আর ওয়াইন প্রশ্নে নেপাল, শ্রীলঙ্কাও বেশি বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে পারছে বিশ্বের বৃহত্তম সমূূদ্র সৈকতের দেশ এই বাংলাদেশের চেয়ে।
গডফাদারদেরও সন্ধান মিলেছে, যদিও গডফাদার শুধু এখন আর তখনকার হিসাব।
বিঃদ্রঃ- প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদয় বিবেচনার জন্য একটি সুপারিশমাত্র এই পোস্টটি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমার কথা ভালো লাগবে এমন নাও হতে পারে
ভালো না লাগলে কী ও কেন ভালো লাগেনি
উল্লেখ করে কমেন্ট করুন
আর ভালো লাগলে তো জানাতেই পারেন